১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হলে ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে মোগল সম্রাট শাহ আলমের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সন্ধি অনুযায়ী বাংলা, বিহার ও ওড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানি গ্রহণ করে। মূলত রাজস্ব আদায়ের দিকে কোম্পানির মনোযোগ ছিল বিধায় দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার দিকে খুব একটা তৎপরতা তাদের ছিল না। কিন্তু ভারতে কোম্পানির কর্মচারীগণ প্রশাসনিক ক্ষমতার ভাগীদার হতে প্রথম থেকে আগ্রহী ছিলেন। কোম্পানির নীতিনির্ধারকগণ সমগ্র দেশের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক ইউনিট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলে ইংরেজগণ রাজস্ব প্রশাসনব্যবস্থার পাশাপাশি ফৌজদারি ও সাধারণ প্রশাসন গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেয়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৬৯-১৭৭০) এর কারণে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর ফলে রাজস্ব আদায় মারাত্নক হুমকির মুখে পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিলেক্ট কমিটি তাই ১৭৬৯ সালের ১৬ আগস্ট রাজস্ব আদায় তদারকির জন্য তৎকালীন বাংলাকে ১৯টি জেলায় ভাগ করে একজন করে ইংরেজ সুপারভাইজার নিয়োগ করেন। রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি তারা তৎকালীন পরিস্থিতিতে সাধারণ প্রশাসনিক কাজও কিছুটা সম্পন্ন করে থাকতেন। অবশ্য এই সুপারভাইজারগণকে তখনই কলকাতা ও চব্বিশপরগণা জেলায় কালেক্টর হিসাবে অভিহিত করা হত। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ক্ষমতায় আসার পর রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় এবং ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়ায় ১৭৭৪ সালে ইংরেজ সুপারভাইজারদের বাদ দিয়ে দেশীয় কালেক্টর নিয়োগ করেন। দেশের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা, প্রজা অসন্তোষ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি একই সূত্রে গাঁথা বিধায় এরই ফলশ্রুতিতে রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছেনা তা বুঝতে পেরে ইংরেজগণ বোর্ড অব রেভিনিউয়ের প্রধান হিসাবে ১৭৮৬ সালে কালেক্টরগণকে সাধারণ প্রশাসনের এবং ১৭৮৭ সালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন জেলা জজের দায়িত্ব পালন করতেন। ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক হিসাবে অফিসিয়ালি না হলেও কার্যত তখন থেকেই জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। ইংরেজগণ এদেশে বিদ্রোহের মুখে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে, শুধুমাত্র ভূমি রাজস্ব থেকে শোষণের ভূমিকায় থেকে এদেশে তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করা সম্ভব নয় বিধায় জনকল্যাণমূলক কাজের দিকে কিছুটা মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেন। এদেশীয় নিযুক্ত শিক্ষিত কালেক্টরগণের মাধ্যমে সাধারণ প্রশাসনের ভার দিয়ে ইংরেজগণ কিছুটা হলেও জনমুখী প্রচারণায় প্রয়াসী হয়ে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। ১৭৭২ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত জেলা ব্যবস্থায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে। এভাবে ইংরেজগণ জেলা প্রশাসনে রাজস্ব ব্যবস্থা, ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার এবং সাধারণ প্রশাসনকে অন্তর্ভু্ক্তি ঘটায়। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থায় ‘কালেক্টরেট প্রশাসন’ বা জেলা প্রশাসন একটি শক্তিশালী ইউনিট হিসাবে কাজ করে যা বিগত দুইশত বছরের অধিক সময় ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এদেশে টিকে আছে।
জেলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়া গেলেও বিভাগ সৃষ্টির বিষয়ে ইতিহাসে খুব সুনির্দিষ্টভাবে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইংরেজগণ রাজস্ব আদায়বিষয়ক চিন্তাভাবনা থেকে মোটামুটি মুক্ত হয়ে রাজ্যসীমা বিস্তার ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে মন দেয়। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে (দি বেঙ্গল রেভিনিউ কমিশনারস্ রেগুলেশন) কালেক্টরের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য সার্কিট হাউজে বিভাগীয় কমিশনারের হাতে কেবল রাজস্ব এবং ফৌজদারি বিষয়ক আপিল শ্রবণের ক্ষমতা রাখা হয়। কমিশনার পদটি তখন থেকে সৃষ্ট। তখন কমিশনারগণ কয়েকদিন যাবৎ সার্কিট হাউজে (তৎকালীন সার্কিট কোর্ট) অবস্থান করে রাজস্ব ও ফৌজদারি আপিল শ্রবণ করতেন। একথা বলে রাখা ভাল, সার্কিট হাউজ তৈরি করা হয় কমিশনারের আপিল শ্রবণ ও রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল ও পরিদর্শনের জন্য। এজন্য সার্কিট হাউজকে কমিশনারের ‘Extended Home’ বা বর্ধিত বাসভবন বলা হয়ে থাকে এবং এ কারণে একমাত্র কমিশনারকেই সার্কিট হাউজের ভাড়া প্রদান করতে হয় না (সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারাও তা নির্ধারিত)। পরবর্তীকালে অবশ্য সাধারণ প্রশাসন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও কমিশনারকে দেয়া হয় যা অদ্যাবধি বহাল আছে। ১৮৩১ সালের শেষ দিকে জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থা পৃথক করে সিভিল জজের পদ সৃষ্টি করায় জেলায় দু’জন কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি হয়। কালেক্টর জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে রাজস্ব আদায়সহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিম্ন ফৌজদারি বিচার এবং সিভিল জজ দেওয়ানি মামলা ও উচ্চতর ফৌজদারি মামলাসমূহ বিচার করতেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারগণ উক্ত তিন জেলার জেলা ও দায়রা জজের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতেন।
১৮৩৬ সালে ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাক্ট’ পাশ হলে জেলা গঠনের প্রথম আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক এবং কমিশনার শব্দটি আইনীভাবে চালু রয়েছে। ‘কমিশন’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘বিশেষ দায়িত্ব’। সেই অর্থে ‘কমিশনার’ শব্দটির অর্থ ‘কোন বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি’।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় তৎকালীন বঙ্গদেশে ১৮২৯ সালে অন্ততঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়। আর প্রত্যেক জেলায় তাদের অধঃস্তন হিসাবে পূর্ব সৃষ্ট কালেক্টরগণকে ডেপুটি কমিশনার, যা বাংলায় জেলা প্রশাসক হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় সেই সময় হতে অর্থাৎ ১৮২৯ সাল হতে চট্টগ্রাম বিভাগের যাত্রা শুরু।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস